সবচেয়ে বাজে সাইনিং থেকে ইতিহাসের শ্রেষ্ট ফুটবলার হয়ে যাওয়া অতপর দীর্ঘ এক যুগের সমাপ্তি
![]() |
শেষবারের মতো সবাইকে বিদায় জানাচ্ছেন মদ্রিচ । ( ছবি : সংগৃহীত) |
নিজস্ব প্রতিবেদক :
ম্যাচের বয়স তখন ৮৭ মিনিট। রেফারির বাঁশি। সাবস্টিটিউট হবেন লুকা মদ্রিচ। বার্নাব্যুর আকাশ যেন মুহূর্তেই ভারী হয়ে ওঠে। গ্যালারির প্রতিটি কোণ থেকে উঠে আসে নীরব কান্না। হাজারো ভক্তরা দাঁড়িয়ে যায়। তাদের চোখে জল, মুখে নির্লিপ্ত হাসি, আর দু'হাতে করতালির শব্দ। সেসব শব্দ ভেদ করে ভেসে আসে একটাই নাম, “Gracias, Luka! Gracias, Legend…”
মদ্রিচ হাত উঁচিয়ে সবাইকে বিদায় জানালেন। তারপর দু’পাশের গার্ড অব অনার ভেদ করে ধীরে ধীরে শেষবারের মতো ডাগআউটের দিকে হাঁটতে লাগলেন। আর পেছনে পড়ে থাকলো- এক যুগের একটা গল্প, একটা মহাকাব্য, একটা চিরচেনা সবুজ মাঠ, যার প্রতিটি ঘাসের ডগায় আঁকা আছে তার জাদুকরী পায়ের ছোঁয়া। এ মাঠের মাঝখানে বসেই তো তিন দীর্ঘ বারোটি বছর নিপুণ পায়ে পৃথিবীর সেরা সেরা চিত্র এঁকেছেন।
মাঠের বাইরে তখন অপেক্ষা করছিলেন তার সহযোদ্ধা, প্রিয় বন্ধু টনি ক্রুস। যিনি লাস্ট সিজনে মাদ্রিদ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আজ বন্ধুর বিদায়ের দিনে এসেছেন। হয়তো বন্ধুত্বের দায়ে কিংবা বন্ধুর বিদায়ের যন্ত্রণাকে একটুখানি লাঘব করতে। আর আসবেন না বা কেন?এই বার্নাব্যুতেই তো তারা একসাথে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, কত রাত একসাথে মহাকাব্য লেখেছেন, অবিশ্বাস্য সব জয়ের পড়ে কাধে-কাধ রেখে উদযাপন করেছেন, হেরে গিয়েও একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সবকিছুরই তো নীরব সাক্ষী এই সবুজ মাঠ আর সফেদ জার্সি। তাই আজও টনি ক্রুস বন্ধুকে জড়িয়ে ধরতে ভুলেননি। জড়িয়ে ধরেছেন, সান্ত্বনা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এরকম কোনো দৃশ্য দেখেই হয়তো লেখেছিলেন, “আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি”
মদ্রিচের অবশ্য আফসোসের কিছু নাই। বয়স হয়েছে, চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। বুট জুড়ো তো এখন থামাতেই হতো। আজ বিদায়ের ক্ষণে মদ্রিচের ঝুলিতে অনেক কিছু আছে, একজন ডেকোরেটেড ক্লাব ফুটবলারের যা যা দরকার সবই মদ্রিচের আছে ৷ ছিলেন মাদ্রিদের সবচেয়ে বাজে সাইনিং, হয়েছেন মাদ্রিদ ইতিহাসের ওয়ান অব দ্যা গ্রেটেস্ট প্লেয়ার। এমনকি তর্কসাপেক্ষে ফুটবল ইতিহাসের গ্রেট মিডফিল্ডারদের একজন।
তবে আফসোস থাকবে আমাদের কিংবা বার্নাবুতে থাকা হাজার ভক্তদের। আমরা মাঝমাঠে আর কোনো ম্যাজিশিয়ানকে তার অবিশ্বাস্য ম্যাজিক দিয়ে দলকে জেতাতে দেখবো না, কোনো চিত্রশিল্পীকে দেখবো না নিখুঁত পায়ে ত্রিভেলা পাস দিতে, কোনো কবিকে দেখবো না অনিন্দ্য একেকটা ’কী পাস' দিয়ে বিস্ময়কর সব জয়ের কাব্য লেখতে।
সবকিছুরও শেষ হয়, নক্ষত্রেরও একদিন পতন হতে হয়। মাদ্রিদের রাজপুত্র মদ্রিচের অধ্যায়ও শেষ হয়েছে। যে অধ্যায়ের শেষ মুহুর্তে নিজের অজান্তেই চোখে মুছতে মুছতে উপলব্ধি করলাম, ফুটবল শুধু একটা খেলা না, একটা অনুভূতির জগত।
ভালো থেকো মদ্রিচ। তুমি মাদ্রিদিস্তাদের হৃদয়ে থাকবে, থাকবে বার্নাবুর গ্যালারিতে, প্রতিটা সাদা জার্সির ভাঁজে ভাঁজে… চিরকাল। আজ তোমাদের বিদায়ের ক্ষণে নজরুলের একটা কবিতা খুব মনে পড়তেছে- “জান কি তোমার বিদায়-কথায়
কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায়
আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায়—
পথিক! ওগো অভিমানী দূর পথিক!
কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো
মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না…”

No comments: