আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে
![]() |
ছবি : সংগৃহীত |
লেখক : হাসান মাহমুদ ইমন
দুখুমিয়ার জন্মের আগে বাংলা ভাষা ছিল নরম, কোমল। এ ভাষায় তখন মিহি মিহি সুরে গান হইতো, প্রতিবাদ হইতো গলা নামিয়ে, কবিতা লেখা হইতো স্নিন্ধতার পরশে । মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলালরা বাংলা সাহিত্যকে অলংকরণে সমৃদ্ধ করলেন, দার্শনিক উচ্চতা দিলেন। কিন্তু ঠিকঠাক মতো আগুনের তাপ দিতে পারেননি।
তারপর একদিন গ্রাম্য এক কেতাদুরস্ত ইমামের ঘরে জন্ম নিল একটা ছেলে, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, মুখ জুড়ে প্রাণখোলা হাসি কিন্তু চোখের দিকে তাকালে মনে হয়- ঠিকরে ঠিকরে আগ্নেয়গিরির লাভা বেরুচ্ছে। সেই ছেলে কলম ধরার পর, বাংলার জনমানুষ বিস্ময়ে দেখল- তাদের সহজ-সরল মাতৃভাষার গভীরে কী তীব্র শক্তির বিস্ফোরণ লুকিয়ে আছে! তাদের ভাষায় আগুন জ্বলে। তারা জানল, এই ভাষায় সিংহাসন কাঁপানো যায়, সাম্রাজ্য কাঁপানো যায়, সমাজ বদলানো যায়।এমনকি তাদের জীর্ণশীর্ণ মুখ থেকেও আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো বের হতে পারে -
”আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!”
নজরুলকে নিয়ে আজও প্লাস-মাইনাসের নোংরা খেলা হয়। নিজের সুবিধামত নজরুলকে ব্যবহার করে তারপর একেক সময় একেক গোষ্ঠী নজরুলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়, সমালোচনায় জর্জরিত করে। অথচ এই অকৃতজ্ঞ মানুষগুলো একবারও ভাবে না, নজরুলের জন্ম না হলে বাংলার মানুষ কোনোদিন জানতোও বাংলা ভাষা কতটা পরাক্রমশালী হইতে পারে। নজরুলের আগমনের পর বাংলা ভাষা তার নিজের একটা আয়না পেয়েছিল। সেই আয়নায় সে দেখল- তার চেহারা শুধু নরম নয়, তার চেহারায় আছে বিদ্রোহ, আছে ক্রোধ, আছে প্রতিবাদ।
নজরুলের জন্মের আগে যে বাংলা ভাষায় প্রতিবাদী লেখাজোখা হয়নি, তা বলছি না। হয়েছে। কিন্তু লেখা দিয়ে জালিমের মসনদ কেউ কাঁপাতে পারেনি। পারলেও একসাথে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আধিপত্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ, মৌলবাদ ও উপনিবেশবাদ- এতগুলো শ্রেণীকে জাস্ট লেখা দিয়ে অস্বস্তিতে ফেলতে পারেনি। নজরুল পেরেছিলেন। ফলে ১৯২২-১৯৩১ এই নয় বছরে তার পাঁচ পাঁচটা বই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ভাবতে পারেন? একজন গরীব কবি একটা বই প্রকাশ করে, সাথে সাথে শোষকশ্রেণীর পশ্চাতে আগুন ধরে যায়, তারপর বিভিন্ন আইন দেখিয়ে তার বইকে নিষিদ্ধ করা হয়।
বই নিষিদ্ধ করলে, কবিকে জেলে ভরে দিলে বুঝি তার কলমকে আটকানো যায়? তার লেখাকে মুছে ফেলা যায়? যায় না। নজরুলের কবিতা ও গান কেউ ভুললো না। গ্রামের মাঠে, শহরের গলিতে, বিদ্রোহের মিছিলে, শ্রমিকের স্লোগানে- নজরুলের কবিতা ও গানেরা বেঁচে রইল।
মওলানা ভাসানী একবার শোষণবিরোধী সংগ্রাম চালানোর সময়বলেছিলেন, ”অন্য অনেককে ছাড়া আমাদের চলে কিন্তু নজরুল ছাড়া আমাদের চলে না।” আসলেই! নজরুল ছাড়া আমাদের চলে না। আমাদের প্রেমের দিনে, আমাদের বিদ্রোহের দিনে, আমাদের বিরহের দিনে, আমাদের আনন্দের দিনে - নজরুল সব সময় আমাদের পাশে থাকেন, আমাদের সুরে কথা বলেন।
এমনকি আমাদের মাটিতে যতবার মুক্তির লড়াই হয়েছে, নজরুল ততবার গর্জে উঠেছেন। আমাদের লড়াইকে জীবিত রেখেছেন। সেই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে ২৪ এর আন্দোলন, আমরাও নজরুলের সাথে গলা মিলিয়ে বলেছি -
‘কারার ঐ লৌহকপাট
ভেঙে ফেল কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী’
আমাদের রাজনীতি, ধর্ম, প্রেম, সমাজ - সবকিছুতে নজরুলকে দরকার পড়ে। ফলে সেই নজরুলকে আমরা প্রায় সময় একান্ত নিজেদের বলে দাবি করি। বিশ্বাস করুন, এটা নজরুলের প্রতি সাংঘাতিক অন্যায়। এতে নজরুলকে সংকুচিত করা হয়। নজরুল নির্দিষ্ট কারো না, উনি সবার আপন হতে চেয়েছিলেন। এমনকি নজরুলের গায়ে ’বিদ্রোহী কবি’, ’অসাম্প্রদায়িক কবি’ টাইপের ট্যাগ সেঁটে দিয়েও নজরুলকে সংকুচিত কইরেন না। নজরুলকে নির্দিষ্ট কোনো শব্দ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করারও দরকার নাই। সেটা আসলে সম্ভবও না। নজরুল হচ্ছেন, এই বাংলার আকাশ। যেখানে সবাইকে ফিরতে হয়।
যে আকাশে সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করে একটা বাক্য- ’আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে’...
শুভ জন্মদিন প্রাণের কবি। আজ ১২৬ তম জন্মদিনে আপনাকে শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করছি।

No comments: