সংবাদ শিরোনাম

recent

মহমারি রোধে ইবনে খালদুনের ‘বায়োপাওয়ার’ পদ্ধতি

::বাশিরুল আমিন::
১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দ, ইবনে খালদুনের বয়স তখন ১৭। দারুণ উদ্যমী এই তরুণ আরবের এ-মাথা ও-মাথা চষে বেড়াচ্ছেন জ্ঞানের খোঁজে। যেখানেই গণিতবিদ কিংবা দার্শনিকের খোঁজ পাচ্ছেন সেখানেই চলে যাচ্ছেন জ্ঞানের অমোঘ তৃষ্ঞা নিয়ে। তিউনিসিয়ার আনাচে কানাচে পৌঁছে গেছে মেধাবী এই তরুণের নাম। গণিত, দর্শন কিংবা ইতিহাস সবকিছুতেই দখল তাঁর। তিনি ইতহাস-দর্শন ইত্যাদির সাথে চিকিৎসাবিজ্ঞানেও মনযোগ দিলেন। ইতোমধ্যে দূর-দূরান্ত থেকে তাঁর কাছে অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও আসতে শুরু করেছে। একদিকে নিজে গভীর অধ্যয়ন করছেন অন্যদিকে শিক্ষার্থীদেরও বিলিয়ে দিচ্ছেন তা থেকে।

ঠিক এমন সময়ে শুনা গেল এক ভয়ংকর মহামারির কথা। চার দিক থেকে ধেয়ে আসছে মৃত্যু। সে এক ভয়ংকর মৃত্যুর মিছিল। ইউরোপ থেকে এশিয়া সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে সে মহামারি। নাম দেওয়া হলো ‘ব্ল্যাক ডেথ’ বা কালো মৃত্যু।

ধারণা করা হলো, জাহাজে অবস্থানকারী এক প্রকার কালো ইঁদুরের মাধ্যমে মহামারিটি ছড়াচ্ছে। মানুষের শরীরে কালো মতো ফুঁড়া হচ্ছে, সেটা থেকে ঘা। ভয়ংকর ব্যথা। খুব দ্রুত গতিতে মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে লাগলো। মানুষের মৃত্যু শুরু হলো, সেই সাথে শুরু হলো হত্যাও।

যে পরিমাণ মানুষ মহামারীতে মরছে তার সাথে তাল মিলিয়ে হত্যাও করা হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। কোথাও গুজব ছড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে ইহুদিদের কোথাও নোঙ্গরকারী জাহাজ পুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার আজগুবি পদ্ধতিতে চিকিৎসার দিয়েও  হত্যা করা হচ্ছে কিছু মানুষ। এভাবে মৃত্যুর মিছিল বড় হতে লাগলো। ইতিহাস থেকে জানা যায় এই ব্ল্যাক ডেথে প্রায় ২০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছে। ইউরোপের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষ জীবন হারিয়েছিল  এই মারিতে।

তখন প্রথমবারের মতো প্রয়োগ করা হলো কোয়ারেন্টিন পদ্ধতি। রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাইকে কোয়ারেন্টিনে চলে যেতে বলা হলো। ৪০ দিনের কোয়ারেন্টিন।  তরুণ গবেষক ও রাষ্ট্রচিন্তক ইবনে খালদুন বিষয়টা ভালো করে প্রত্যক্ষ করতে চাইলেন। গভীরভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি অনুধাবন করলেন। কী মার্মান্তিক অনুধাবন! চোখের সামনেই মহামারিতে মারা গেলেন তাঁর বাবা-মা দুজনেই। 

খুব মর্মাহত হলেন ইবনে খালদুন। কোয়ারেন্টিন বিষয়টি তাঁর কাছে অকার্যকর মনে হলো। তিনি ভাবলেন কোয়ারেন্টিন মাহামরি রোধে খুব কার্যকরী কিছু না। এটা কেবল রাষ্ট্রের একটা দায়সারা ফরমান। কারণ রাষ্ট্র যেহেতু সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না তখন সেটার দায়িত্ব নাগরিকের ঘাড়েই তুলে দিতে চাচ্ছে। পরবর্তীতে মিশেল ফুকোও এরকম ভেবেছিলেন। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’।  
ইবনে খালদুন এ নিয়ে ভাবলেন, গবেষণা করলেন। এরকম মহামারি কেন হচ্ছে? আর কিভাবে এর প্রতিরোধ সম্ভব? তিনি এর দুয়েকটা পথও খুঁজে বের করলেন। তিনি এ জন্য রাষ্ট্র আর ক্ষমতাকে দায়ী করলেন এবং এ থেকে পরিত্রাণের জন্যও রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে বললেন।

পরবতীর্তে তিনি যখন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুকাদ্দিমা লিখলেন তখন তাতে মহামারির কারণ ও তা প্রতিরোধের উপায় বাতলে দেন। আল মুকাদ্দিমার একান্নতম পরিচ্ছেদে মহামারির কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে  ইবনে খালদুন যা লিখেছেন তা গোলাম সামদানী কোরায়শী অনূদিত গ্রন্থ থেকে হুবহু উল্লেখ করা হলো,
 ‘এর কারণ সাধারণভাবে জনবসতির আধিক্যের জন্য আবহাওয়া দূষিত হওয়া। কারণ ঘনবসতির জন্য দূর্গন্ধ ও দূষিত আর্দ্রতার সংস্পর্শে এসে জীবাত্মার আহার্যবায়ু বিকৃত হয়ে ওঠে। এরূপ বিকৃতির কারণ হলে বায়ুর মিশ্রণ বিগড়ে যায় সুতরাং এরূপ বিকৃতি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছলে তা দিয়ে ফুঁসফুস রোগাক্রান্ত হয়। এর ফলেই ফুসফুস সংক্রান্ত মহামারীর প্রাদুর্ভব ঘটে।’

ফুসফুস সংক্রান্ত মহামারীর যে দুটি কারণ তিনি উল্লেখ করেছন। দু’টিই বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেই সাথে ফুসফুসের মহামারিও। প্রথমত আমরা খুব ঘনবসতি এলাকা গড়ে তুলছি দ্বিতীয় আমরা বায়ুদূষণ করছি। আজ থেকে ৭০০ বছর আগেই এ দু-টি বিষয়কে মহামারির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইবনে খালদুন। তার কথা থেকে এটা পরিষ্কার যে আমরা যদি এভাবে পরিবেশকে আরো দূষিত করতে থাকি তবে ভবিষ্যতেও নিশ্চিতভাবে আরো মহামারি আসতে থাকবে। 

আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, তিনি এই পরিচ্ছেদের-ই অন্য একটা জায়গায় মহামারিকে কোনো একটি সম্রাজ্যের পতনের নিদর্শন  হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথার সূত্র ধরে আমরা কি এখন কোন একটি সম্রাজ্যের পতনের অপেক্ষা করতে পারি ? 

ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে ইবনে খালদুন কোয়ারেন্টিনের বদলে অন্য ব্যবস্থাপনার কথা বলেছেন এবং বায়োপাওয়াররের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ডিসিপ্লিনারি পদ্ধতিকে অনুৎসাহিত করেছেন। তাঁর ফোকাস ছিল পরিবেশ ও অবকাঠামোর উপর। 

১৮৩০ সালের দিকে ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে যখন কলেরা মহামারি দেখা দিয়েছিল, তখন তারা ইবনে খালদুনের বায়োপাওয়ার পদ্ধতিকে ফলো করেছিল। রাষ্ট্র পরিবশে, অবকাঠামো ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার ওপর বিনিয়োগ করেছিল।

পরিবেশের উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে ইবনে খালদুন লিখেন, জনবসতির মধ্যে স্থানে স্থানে শূণ্যভূমি ও খোলা মাঠ থাকা প্রয়োজন যাতে বায়ুর প্রবাহ প্রাণীকূলের সংস্পর্শে দূর্গন্ধ ও পচনে দূষিত বায়ুকে দূর করে তদস্থলে বিশুদ্ধ বায়ু আনয়ন করতে পারে।  অন্য একটি পরিচ্ছেদে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার কথাও উল্লেখ করেছেন এই ইতহাসবিদ। 

সাত শত বছর আগে ইবনে খালদুন যেভাবে মানুষকে পরিবেশের ব্যপারে সতর্ক করেছেন আমরা এতোটা বছর পর এতোটা আধুনিক হয়েও পরিবশেকে সেভাবে দূষণমুক্ত রাখতে পারছি না । এটা আমাদের জন্য বেশ লজ্জাকর। 





লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক







সূত্র:
১. আল মুকাদ্দিমা, ইবনে খালদুন, গোলাম সামদানী কোরায়শী অনূদিত, দিব্য প্রকাশ,  তৃতীয় মুদ্রণ, ২০১৫,  পৃ: ৫১১-৫১২
২. Ibn Khaldūn, by Franz Rosenthal (2008)
3. The Great Mortality: An Intimate History of the Black Death, the Most Devastating Plague of All Time, by John Kelly (2006)
মহমারি রোধে ইবনে খালদুনের ‘বায়োপাওয়ার’ পদ্ধতি Reviewed by প্রান্তিক জনপদ on 6/14/2020 11:19:00 PM Rating: 5

No comments:

Copyright © Prantik Jonopd All Right Reseved 2020
Created by Thawhid Shahin

যোগাযোগ ফর্ম

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.