
গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে, অপরাজিত থেকে ছাড়লেন মাঠ
মিশুক নজিব:
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি একসঙ্গে একাধিক আসনে নির্বাচন করছেন, কিন্তু কখনো হারেননি। যখন যেখানে দাঁড়িয়েছেন, তুমুল জনপ্রিয়তায় ভর করে সেখান থেকে জয় নিয়ে ফিরেছেন।
এবার তাকে থামতে হলো জীবনের পথে। ৮০ বছর বয়সে এসে থেমে গেলো বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নিঃশাস। এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো তার রাজনৈতিক জীবন। কিন্তু অপরাজেয়-ই থাকলেন রাজনীতির মাঠে।
রাজনীতিতে আসা
১৯৮১ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, তার আগে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে তার স্ত্রী খালেদা জিয়াকে তেমন একটা দেখা যেতো না।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর দল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে তৎকালীন বিএনপির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতার পরামর্শ ও অনুরোধে ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। ২ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হন তিনি।
পরের বছর মার্চে খালেদা জিয়া সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদোন্নতি পান।
১৯৮৪ সালের আগস্টে চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন পদে আসীন ছিলেন।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম শিশু ও এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
এছাড়া, নজরুল ইসলাম খান ও জমির উদ্দিন সরকারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ বিবিসি বাংলাকে এ তথ্য জানিয়েছিলেন।
এছাড়া, অন্য রাজনৈতিক দল থেকেও খালেদা জিয়াকে বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। এক্ষেত্রে হায়দার আকবর খান রনো ও রাশেদ খান মেননের নাম উল্লেখযোগ্য।
হায়দার আকবর খান রনো তার আত্মজীবনী 'শতাব্দী পেরিয়ে' বইতে এ নিয়ে লিখেছেন, 'আমরা খালেদা জিয়ার কাছে প্রস্তাব করলাম, আপনি রাজনীতিতে আসুন, বিএনপির হাল ধরুন, এক্ষেত্রে এরশাদের বিরুদ্ধে লড়ব। এরশাদ সম্পর্কে তার ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু সরাসরি রাজনীতি করবেন কি না সে সম্পর্কে কিছু বললেন না। দেখলাম, তিনি স্বল্পভাষী, তবে আমাদের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। কোনও কথা ঠিক মতো বুঝতে না পারলে, প্রশ্ন করে ভালো করে বুঝে নিচ্ছিলেন। সবশেষে তিনি বললেন, ভেবে দেখব।'
যদিও খালেদা জিয়া বিএনপির প্রধান নেতৃত্বে আসুক, তা তৎকালীন সামরিক নেতা, গোয়েন্দা বিভাগ চায়নি বলে অনেক সময় বিশ্লেষকেরা বলেছেন।
গণতন্ত্রের আন্দোলনে বিজয়ী খালেদা জিয়া
বিএনপিতে যোগ দিয়েই খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলনের সূচনা করেন। এর মধ্যে এরশাদের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে ১৯৮৩ সালে গঠিত সাত দলীয় জোট গঠনের স্থপতি ছিলেন তিনি।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন খালেদা জিয়া।
তিনি ১৯৮৬ সালের কারচুপির নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। এই সিদ্ধান্ত ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুর দিকের বড় টার্নিং পয়েন্ট।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ফোকাসটাই নিজের দিকে করে নিয়েছিলেন স্বৈরচারের সাথে হাত না মিলিয়ে। তকমা পান আপোষহীন নেত্রীর।
এই সময় বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলকে শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করেন, যার ফলে সারাদেশে ৩২১টি ছাত্র সংসদের মধ্যে ২৭০টিতে জয়লাভ করে ছাত্রদল।
এই ছাত্ররা এরশাদের শাসনের পতনের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী
এরশাদকে হটিয়ে ’৯১-এ যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়, এর পথচলায় দেশের জনগণ বেছে নিয়েছিলেন বিএনপিকে। আর দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রথম নারী, যিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেন।
খালেদা জিয়ার দুই শাসনামলের মধ্যে পঞ্চম সংসদ তুলনামূলক ভালো ছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন করতে দেখা যায়।
তবে, ১৯৯৪ সালে মাগুরায় উপ-নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ খালেদা জিয়ার এই শাসনামলে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে বিরোধী দলগুলো রাজপথে নামে।
তত্ত্ববধায়ক সরকার ও বিতর্কে খালেদা জিয়ার বিএনপি
বিরোধী দলগুলোর দাবি না মেনেই পঞ্চম সংসদের ইতি টানা হয়। এরপর বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে ১৯৯৬ সালে দলীয় সরকারের অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে বিএনপি ফের ক্ষমতায় আসে।
তবে এই সংসদ স্থায়ী ছিল মাত্র ১২দিন। দলগুলোর আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে তৎকালীন বিএনপি সরকার।
সেই বিধান অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালে সপ্তম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।
ফের ক্ষমতায়
পাঁচ বছর পর নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে ২০০১ সালে সংসদে আসে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। খালেদা জিয়া আবারও প্রধানমন্ত্রী হন।
তার এই শাসনামলে দুর্নীতি, দেশে জঙ্গী হামলা বেশ আলোচনায় আসে। তবে, জঙ্গীদের দমনে তার সরকার চেষ্টা ছিল লক্ষণীয়।
এই সরকারের বিদায়বেলায়ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। এবার ছিল পছন্দের মানুষকে বসানোর অভিযোগ।
এই অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলো একপর্যায়ে ভোট বজনের পথে যায়; যে নির্বাচনটি ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। আসে এক-এগারো।
এক-এগারো ও নির্বাসনে যেতে আপত্তি
এক-এগারো দেশের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন এনে দেয়। এখনও এই অধ্যায় ভুলেননি রাজনীতিবিদরা। জেলে যান প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতা খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা, ২০০৭ সালের কথা এটি। পরের বছর দুইজনেই মুক্তি পান।
দলগুলোর বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ নেতার ঠিকানা-ও হয় কারাগার। খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকো-ও বাদ পড়েননি এই তালিকা থেকে।
এর বাইরে মাইনাস টু ফর্মুলা ছিল ওই সময়ে রাজনীতিতে বড় আলোচিত ঘটনা।
তবে, দুই নেত্রীকে সরানো যায়নি রাজনীতি থেকে। এক-এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছরের মাথায় নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতে বাধ্য হন।
ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আপত্তি ছিল খালেদা জিয়ার। তবে, জোটের চাওয়াসহ নানা কারণে শেষ পর্যন্ত ভোটে গিয়ে ভালো ফলাফল জুটেনি দলটির।
বিপরীতে আওয়ামী লীগ একতরফা জয় পায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ভোটে।
‘দেশ বাঁচাও’ স্লোগান, বাড়ি ছাড়া এবং লড়ে যাওয়া
নবম সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিএনপির স্লোগান ছিল দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও। এ যেন খালেদা জিয়া তার চোখে বাংলাদেশের অদূর ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিলেন। সাড়ে ১৫ বছরে দেশের এই দৃশ্য তরুণ থেকে বৃদ্ধ সবাই দেখেছেন।
আওয়ামী লীগের এই শাসনামলের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ২০১০ সালে তিনি মঈনুল রোডের বাড়ি হারিয়েছেন। বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার এই দৃশ্য মানুষের মনে দাগ কাটে।
খালেদা জিয়ার বিএনপির নেতৃত্বেই সমমনা দলগুলো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়ে যায় এক যুগের বেশি সময় ধরে।
ফের কারগারে ও মুক্তি
দুর্নীতি মামলায় দণ্ড পেয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান খালেদা জিয়া। পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারের অফিস ভবনে রাখা হয় তাকে। পরে আরও একটি মামলায় তার সাজা হয়েছিল।
সরকারের নির্বাহী আদেশে দুর্নীতির দু'টি মামলায় বিএনপি নেত্রীর সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
তখন থেকে ৬ মাস পরপর ধাপে ধাপে তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। এর মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়া হাসপাতালে ভর্তি হন একাধিকবার। তখন তার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছিল বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর বিষয়ে। কিন্তু সেই আবেদন প্রত্যাখান হয়।
৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পরদিন সাজা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পান খালেদা জিয়া। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর দণ্ড মওকুফ করার কথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।
উন্নত চিকিৎসার জন্য পঁচিশের ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছিলেন খালেদা জিয়া। সেখানে চিকিৎসা নিয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশে ফিরেন।
নভেম্বরের শেষের দিকে আবারও ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এবার আর সুস্থ হয়ে ফিরলেন না ফিরোজায়। চলে গেলেন পরপারে।
অনলাইন থেকে সংগৃহীত।
No comments: