সংবাদ শিরোনাম

recent

সচিবদের ভন্ডামির গোঁমর ফাঁস

 

আমিনুল ইসলাম ইমন

আমলাদের সাথে পাঁচ বছর কাজ করেছি। সপ্তাহে  কমপক্ষে দুইদিন মন্ত্রণালয়ে যেতে হতো। 

কয়েকটা অভিজ্ঞতা বলি।

১ 

মন্ত্রানালয়ের  মিটিং রুমে  বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত হয়।  মিটিং শুরুর আগে আনুমানিক চল্লিশটা চেয়েরের মধ্যে কে কোন চেয়ারে বসবেন সেটার  অলিখিত এক জটিল ডিফারেসিয়াল ক্যালকুলাসের মাধ্যমে তারা হিসাব করেন এবং সঠিক চেয়ারে তারা বসে পরেন। তাদের জীবনের সব কাজে ভুল হয়, কিন্তু চেয়ার চিনতে ভুল হয় না। 

মিটিং এ মূলতঃ তাঁরাই  কথা বলেন যারা ওই কাজের ব্যাপারে সবচেয়ে কম জানেন।  যারা কাজ বা প্রকল্প সম্পর্কে জানেন,  ডকুমেন্ট গুলো বানিয়েছেন এবং মাঠে থেকে কাজটা  করবেন,  তাদেরকে দ্বিতীয় সারির  চেয়ারে  বসিয়ে রাখা হয়।   প্রশ্ন না করা হলে তাদের মুখ  বন্ধ রাখাই নিয়ম। 

৩ 

মিটিং এর উচ্চ পদ-ধারী দু তিন জন বাদে বাকি সবার বক্তব্য হয় দুই/ তিন মিনিট করে। তারা এই অল্প সময়ের মধ্যে উপস্থিত সকলের নাম, পদবী   উল্লেখ করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আনুগত্য ইত্যাদি উচ্চারণ করতে করতে বেশিরভাগ সময় চলে যায়  এবং রাজনৈতিক দল গুলোর নেতাদের মতই তাদের নিজস্ব মত থাকে না বলে বক্তব্যের শেষ মিনিটে মিটিং এর  চেয়রপার্সনকেই মতামত দিতে অনুরোধ জানান। 

ভণ্ডামি, বাটপারি, তেলবাজি, অভিনয়, স্বজনপ্রীতি, দলবাজি ও গ্রুপিং। এগুলো দেশের সব অফিসে থাকলেও, মন্ত্রণালয়ের মত এত নিষ্ঠা, মেধা ও সময় দিয়ে প্র্যাকটিসের উদাহরণ আর কোন সরকারি বা বেসরকারি সেক্টরে নাই।  এগুলো করা  ছাড়া  শুধু কর্মদক্ষতা ও সততা দিয়ে মন্তনালয়ের উচ্চ পদে যাওয়ার  কোন রাস্তা নাই। এগুলো না পারলে   জয়েন্ট সেক্রেটারি হবে তার জীবনের শেষ পদ। 

৫ 

মিজানুর রহমান নামে এরকম এক জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন,  স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। উনি মাইনাস টু ফর্মুলার জন্য ব্যাপক সক্রিয় ছিলেন। একটা প্রকল্প ভিজিটে তার সাথে সিলেট গেছিলাম।সেখানে  প্রায় দৌড়ে টিলার মাথায় উঠে গেলেন। সেই  উনি যখন কিছুদিন পর টের পেলেন মাইনাস টু হচ্ছে না  বরং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে,  এরকম সময়ে তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে সবাইকে মুক্তি যুদ্ধের গল্প শোনাতে লাগলেন। কিছুদিন পর তার ডান পায়ের গোড়ালিতে গুলি লেগে ক্ষত হয়েছে বলে নিজের পা দেখাতে লাগলেন। সেখানে অবশ্য কোন ক্ষত কেউ না দেখতে পেলেও সবাই খুবই সাহানুভুতির কথা বলতেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আগে তার সেই চল্লিশ বছর আগের গুলি খাওয়া পায়ের  গোড়ালির ব্যাথা বেড়ে গেল। উনি পঙ্গু হসাপাতাল থেকে এলুমিনামের লাঠি কিনে  হাতে ধরে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। 

তার পরের ঘটনা সবার জানা আছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার দুই মাসের  মধ্যে   এডিশনাল সেক্রেটারি হলেন। কয়েক মাস পরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পূর্ন সচিব হলেন। বিপুল উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট বিক্রি করতে লাগলেন। এক দিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করবো কি না। জন্ম একাত্তরের পরে হবার কারণে আবেদন করতে  না পেরে খুব আফসোস করলাম।

এই ভদ্রলোকই মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারতীয় সেনাদের ডেকে গোল্ড মেডেল দিয়েছিলেন। এবং সেই গোল্ড মেডেলে যে  কোন গোল্ড নাই সেটা নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক হইচই হয়, এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে অনেক হাস্যরস হয়। 

ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো উনি একা না, আমি আরো  কয়েকজন সচিবকে দেখেছি একই ধরনের কাণ্ড করতে।

 এবং আমি এ ও নিশ্চিত যে  ভবিষ্যতে জামাত ক্ষমতায় আসলে দ্রুত দাড়ি রেখে তারা যে গোপনে হিজবুত তাহরীর করতেন সেই  গল্প প্রচার করে বেড়াবেন।  

৬ 

এরা খুব বিদেশ ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। সেখানে নাকি তারা ট্রেইনিং নেন। কতটুকু ট্রেইনিং করেন আর কতটুকু ঘুরে বেরান সেটা আমরা জানি। সেই প্রসঙ্গে এক ম্যাডাম সেক্রেটারির গল্প বলি। উনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে অনেক গুলো দেশ ভ্রমণে গেলেন, নিম্ন আয়ের আবাসন বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা নিতে। সেই প্রকল্পের ডিজাইনার আমি। আমার  যাওয়া দুরে থাক উনি কি দেখে আসেন আর কি শিখে আসেন আমাকে না কাওকে বলেন না। ভাবলাম কোন একদিন হয়তো  বলবেন। 

 একদিন  সব ট্যুর শেষ হলো। আমি দেখা করতে গেলাম। যেয়ে দেখি ওই দিন তার বিদায় সম্বর্ধনা হচ্ছে। উনি মৎস্য মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছেন। আমাকে সময় দিলেন। আমি বললাম আপনি যে এত কিছুর ট্রেইনিং নিলেন সেগুলো এখন দেশের কী কাজে লাগবে? মৎস্য মন্ত্রণালয়ে যেয়ে  কীভাবে  কাজে লাগবেন এগুলো? উনি গম্ভীর ভাবে বললেন অভিজ্ঞতা থাকলে কোন না কোন কাজে লাগবেই। পাশে বসা উপ-সচিব মাথা নেড়ে সায় দিলেন। 


এরকম শত শত অভিজ্ঞতা আছে। যারা ওখানে বেশিদিন থাকে তারা  এই অদ্ভুত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাদের কাছে এটাই স্বাভাবিক। 

দেশে রাজনীতির পরিবর্তন হয়। সকল প্রতিষ্ঠানের কম বেশি পরিবর্তন হয়। ভূমিকম্প হলে হিমালয় পর্বতমালাও দু তিন ইঞ্চি নড়ে চড়ে বসে। কিন্তু বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তন অসম্ভব।ড:  ইউনুস এর প্রভাব  হয়তো দেশের রাজনীতিতেও খানিকটা পরিবর্তন আনতে পারবে, কিন্তু এই মন্ত্রণালয়ের কালচারের পরিবর্তন আনতে পারা আমার মতে অসম্ভব।

তার পরেও Hasnat Abdullah কে বলবো, চেষ্টা করো, দেখো কী হয়।

আমিনুল ইসলাম ইমন

সাবেক সচিব

সচিবদের ভন্ডামির গোঁমর ফাঁস Reviewed by প্রান্তিক জনপদ on 5/29/2025 05:18:00 PM Rating: 5

No comments:

Copyright © Prantik Jonopd All Right Reseved 2020
Created by Thawhid Shahin

যোগাযোগ ফর্ম

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.