সংবাদ শিরোনাম

  

তিন বছরে ৪২ জন চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন দেখে নিউরোসার্জন যা বললেন


আজ থেকে প্রায় ৮ বছর আগের কথা। আমার সন্তানের কোমরে চিন-চিন পেইন, মাঝে-মধ্যে কোমর থেকে হাটু পযন্ত ক্রমান্নয়ে যায় সেই পেইনটি। বাচ্চার বয়স তখন ১৬ বছর। সিলেটে এক বছরে প্রায় কুড়ি জন ডাক্তার দেখালাম। ভারতীয় একজন ডাক্তারকেও দেখালাম, যিনি সিলেটে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে একদিন রোগী দেখেছিলেন। তিনি ফিসটা রেখে ভারতীয় একজন ডাক্তারের কাছে রেফার করেন।

সিলেটে 'রোগটি চিনতে পারলাম না' সব ডাক্তার একই কথা বলেন। তারা প্রতেকেই আবার ফিসটা রেখে রেফার করেন অন্য ডাক্তারের কাছে। রোগ হওয়ার এক বছর পর ডাক্তার বাকী বিল্লাহ সাহেবের চেম্বার থেকে আমার স্ত্রী মোবাইলে কল করে কেঁদে কেঁদে বলেন, আমাদের সব'নাশ হয়ে গেছে।

আমি ভাবলেশহীন মানুষ। ছিলাম সিলেট মহানগরীর জিন্দাবাজার রাজা মেনশনের দীর্ঘ ২৫ বছরের ছাপার বেবসায়ী। কোন বিষয়ে বেশি ভাবতাম না। তার কান্নার মাঝে যা বুঝলাম, আজ রোগ ধরা পড়েছে। টেস্ট করায় ১৬ হাজার টাকা লেগেছে। সোবহানীঘাটস্হ ইবনে সিনার ডাক্তার বাকী বিল্লাহ বলেছেন, বাংলাদেশে শুধুমাত্র ঢাকার এক জায়গায় হয় অপারেশন হয়। ইন্সপাইনাল কড অথাত পীঠের হাড্ডি অপারেশন করে একটি পদার্থ বের করে ফেলে দিতে হবে। তবে উন্নত কোন দেশে করালে ভালো হবে।

তারপর ইবনে সিনার ডাক্তার বাকী বিল্লাহর বণনাকৃত বাংলাদেশের অপারেশনের স্হান ঢাকার একমাত্র নিউরোসাইন্স হাসপাতালে চারজন মিলে যাই। ডাক্তাররা শুধুমাত্র সিলেট ইবনে সিনার বাকী বিল্লাহর কাগজ দেখলেন। তারপর তাদের মূল্যবান সময়টা খরচ না করেই বললেন যে, এখানে ভতি হয়ে অন্তত ১৫/১৬ দিন অপেক্ষা করতে হবে। তারপর অপারেশন। খরচের কথা জানতে চাইলাম। তারা বললেন, যেহেতু হাসপাতালটি সরকারি, সেহেতু অপারেশনের কোন খরচ লাগবে না। শুধুমাত্র ৬/৭ লাখ টাকার ঔষধ পত্র লাগবে। আমাদের পক্ষে এতদিন থাকাটা অসম্ভব।

আমরা আবারও সিলেট চলে এলাম। ভাবতে লাগলাম কি করা যায়। ইবনে সিনার ডাক্তার বাকী বিল্লাহর সাথে আবার যোগাযোগ করি। তাকে জিজ্ঞেস করি, সবস্ব বিলিয়ে আমরা না হয় অপারেশন করলাম। পুরোপুরি ভালো হবে তো। ডাক্তার বাকী বিল্লাহ বললেন, কোন উন্নত দেশে করালে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর আমাদের দেশে করালে ৫০% সম্ভাবনা ভালো হওয়ার। এত টাকা খরচ করে ভালো হওয়ার নিশ্চয়তা আবার নেই।

ইবনেসিনার ডাক্তার বাকী বিল্লাহ বললেন, ২ মাসের মধ্যে চিকিৎসা না করালে পা-টি বেন্ড হয়ে যাবে। কিন্তু অপারেশন করার পরও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।

আমরা যোগাযোগ করি দিল্লির নামকরা একটি হাসপাতালে। তারা অফার করেন সবমোট বাংলাদেশী ১৫ লাখ টাকায় পুরো অপারেশন করে দেবেন। নিউরোসার্জনের ছবি ও যাবতীয় কাগজ পাঠানো হয় আমার ই-মেইলে। আমরা পাসপোর্ট সহ আনুষাঙ্গিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করি। 

ইতিমধ্যে আমার যোগাযোগ হয় জনৈক আমেরিকান বন্ধুর সাথে। তিনি আমার কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চান। তিনি আমাকে সেখানকার একজন বিশিষ্ট মহিলা নিউরো সার্জনের সন্ধান দেন। অতঃপর ডাঃ জামুরানোর সাথে যোগাযোগ হয়। তিনির হিসাবে বাংলাদেশী প্রায় ১৬ লাখ টাকা অপারেশনের খরচ। তিনি তার পিএস ডিনাইস বাসেলের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। তিনিও একজন মহিলা ডাক্তার। ই-মেইলে আমাদের যোগাযোগ চলছিল।

বন্ধু আরো বললেন যে, ইন্ডিয়ায় গিয়ে ১৫ লাখ খরচের চেয়ে আমেরিকায় ১৬ লাখ টাকা খরচ করা উত্তম। ইন্ডিয়ায় প্রতারণার একটি ভয় আছে, যা আমেরিকায় নেই। আর আমার মেনেজার দিলোয়ার ভাই ছিলেন লন্ডন থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক ডিগ্রিধারী। তাই ই-মেইলে যোগাযোগে আমাদের যোগাযোগে খুব সুবিধা হয়েছিল।

যোগাযোগের এক পযার্য়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেই নিউরোসার্জন ডাঃ জামুরানোর কাছে মিশিগান সিটিতে যাওয়ার। কিছু আত্মীয় স্বজনরাও সাহস দেন। ডিনাইস বাসেল ভিসার পাওয়ার জন্য যাবতীয় কাগজপত্র দেন। এরপর আমেরিকান দূতাবাসের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করি। কিন্তু তারপরও ভিসার আবেদন রিফিউজ হয়।

ডাক্তার বাকী বিল্লাহ বলেছিলেন, দুই মাসে পা পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে চলে গেছে তিন বছর। শুধু পায়ে মাঝে মধ্যে সমস্যা করে। সাহস আমাদের অনেকটা বেড়ে গেল। এরই মধ্যে খবর পেলাম ঢাকা নিউরোসাইন্স হাসপাতালের এক সিলেটি ডাক্তার মাসে একদিন রোগী দেখেন সোবহানীঘাটে। ইবনে সিনা পয়েন্ট আর উপশহর পয়েন্টের মধ্যিখানের একটি ক্লিনিকে। তার এপয়নমেন্ট নিলাম।

তিন বছরের আমাদের কাছে সিলেট ও ঢাকার ৪২ জন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখে তিনি হতবাক। তিনি ইবনে সিনার ডাক্তার বাকী বিল্লাহর একটি রিপোর্ট দেখিয়ে বললেন, এই রিপোর্টই সমস্যার মূল কারন। প্রথম বছরে ২০ জন সবাই অন্যজনের কাছে রেফার করেছেন, বাকী দুই বছরে ২২ জন সবাই ভুল পথে হেটেছেন। তিনি আমার কাছে ডাক্তার সমাজের পক্ষ থেকে ক্ষমা চান। বললেন, ডাক্তাররা কেউ পেছনে ফিরে তাকাননি। একজন যে ভুল করেছেন, সবাই সেই ভুল পথেই হেটেছেন। অযথাই আপনাদের কষ্ট দিয়েছেন। ভাগ্য ভালো যে আপনারা এখনো অপারেশন করেননি। অপারেশন করালে সত্যি সব'নাশ হয়ে যেত। 

কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি। এই ঔষধ এক সপ্তাহ খাওয়ার পর প্রয়োজনে আমাকে এই ফোন নাম্বারে আমাকে জানাবেন। ঔষধ ৮০ টাকার কিনে আমরা বাসায় চলে এলাম। এই ঔষধ বেবহারের পর আজ পযন্ত কোন সমস্যা হয়নি।

ঢাকা-সিলেট দৌড়াদৌড়ি আর ডাক্তার দেখানোতে আমাদের তিন বছরে প্রায় তিন লাখ খরচ হয়ে গিয়েছিল চিকিৎসা না করেই। এখন তার আর কোন সমস্যা নেই। আল্লাহর রহমতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে এই ৮০টাকার ঔষধ সেবন করেই।

শিক্ষা :

রোগ যতদিন চিহ্নিত না হবে, ততদিন নতুন ডাক্তারকে কখনও পুরাতন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখাবেন না। তাহলে নিজে মাথা না ঘামিয়ে পুরনো সেই ভুলটাই পূনরায় করবে। কাউকে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেবেন অনেক ভেবে-চিন্তে। শুধু ডাক্তার বললেই আত্মঘাতী এই সিদ্ধান্ত নেবেন না। ডাক্তারের কথায় অপারেশন করালে আমাদের সন্তানটি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত না।।


লেখক:- মঈনুল হক মঈন 

তিন বছরে ৪২ জন চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন দেখে নিউরোসার্জন যা বললেন Reviewed by প্রান্তিক জনপদ on 3/26/2024 11:12:00 PM Rating: 5

মন্তব্য

Copyright © Prantik Jonopd All Right Reseved 2020
Created by Thawhid Shahin

যোগাযোগ ফর্ম

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.