অদম্য মেধাবী : দারিদ্র্য দমাতে পারেনি সেবুলকে
আশিস রহমানের প্রতিবেদনঃ
সংসারের আর্থিক টানাপোড়নের মধ্যেই বেড়ে উঠা। অন্যান্য সহপাঠীদের মতো পড়াশোনা, আড্ডা আর খেলাধুলার সুযোগ ছিল না। অর্থাভাবে প্রাইভেট টিউশনির টাকা যোগাতে পারতেন না। ছিল না টেস্ট পেপার কিংবা ভালো পোশাক কেনার সামর্থ্যটুকুও। প্রায় দিন উপোস থেকেও ক্লাস করতে হয়েছে। এভাবেই নানান বাধা বিপত্তি পথ অতিক্রম করে সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার অদম্য মেধাবী সেবুল আহমেদ সোহাগ।
সেবুল এ বছর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত হাওর বেষ্টিত এলাকার একমাত্র বিদ্যাপীঠ মুহিবুর রহমান মানিক সোনালী নূূর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক শাখায় এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। তার আশপাশের বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সেই একমাত্র মানবিক শাখায় জিপিএ -৫ পাওয়া শিক্ষার্থী। তার বিদ্যালয়েও এই প্রথম এসএসসি ব্যাচ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে সে।
অভাব টানাপোড়নের মধ্যেও বাবা-মায়ের প্রেরণায় ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় কঠোর পরিশ্রম করে এবার এসএসসির রেজাল্টে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানো সেবুলের বাড়ি উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক মোহাম্মদ সিরাজ মিয়া ও গৃহিণী সেলিনা আক্তারের ৫ সন্তানের মধ্যে সবার বড় সেবুল। তার ইচ্ছে ছিলো বিজ্ঞান শাখা নিয়ে পড়াশোনা করার। কিন্তু একদিকে সংসারের আর্থিক টানাপোড়ন অন্যদিকে নিকটস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান শাখা না থাকায় তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ফলাফল প্রকাশের পর সরেজমিনে হতদরিদ্র মেধাবী সেবুলের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, সোনাপুর গ্রামের এক প্রান্তে সুরমা নদীর পাড়ে সামান্য জমির ওপর ভাঙ্গাচোরা বাঁশ বেতের, মাটির বেড়ার ও পুরোনো টিনের একটি ছোট্ট ঘর। নদী গ্রাস করে নিয়েছে বসতবাড়ির আঙিনা।
সেবুল আহমেদ সোহাগ জানায়, সংসারের এবং নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে ভোরে নদীতে গিয়ে মাছ ধরতে যেতাম। মাছ ধরা শেষ করতে গিয়ে স্কুলের ক্লাসের সময় চলে আসতো। স্কুল থেকে ফিরে বাবার সাথে কৃষি কাজে সহায়তা করতাম, কখনো অন্যের জমিতেও কাজ করতাম। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত স্থানীয় বাজারে ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা হিসেবে কাজ করেছি। কাজ শেষ করে রাত এগারোটায় বাড়িতে ফিরতাম। মধ্যরাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে ঘুমিয়ে পরতাম।
শেবুল জানায়, তার বয়োবৃদ্ধ বাবার সামান্য আয় দিয়ে সংসার চলতো না। প্রায় দিনই কোনো না কোনো বেলা কোনোরকমে খেয়ে না খেয়েও থাকতে হয়েছে। ছোট্ট ভাই ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করে ঝড়ে পরেছে। সে এখন পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে বাবার সাথে সাংসারিক কাজে সহায়তা করছে। আরেক ছোট্ট বোন ক্লাস সেভেন পড়াশোনা করছে। বাড়তি আয় রোজগারের ব্যবস্থা না থাকায় তার বাবার একার পক্ষে একসাথে ৫ সন্তানের ভরণপোষণ ও পড়াশোনার খরচ চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
ফলাফল প্রকাশের পরদিনই স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন আলীপুর সমাজকল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দদের নিয়ে সেবুলকে অভিনন্দন জানাতে তার বাড়িতে ছুটে আসেন মুহিবুর রহমান মানিক সোনালী নূর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম। বাড়িতে শিক্ষক ও অতিথিদের পেয়ে আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন সেবুলের পিতা মোহাম্মদ সিরাজ মিয়া।
তিনি জানান, আমার ছেলে ভালো রেজাল্ট করেছে শোনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। সে সবসময়ই কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আমাদের অভাবের সংসারে জন্য আয় উপার্জন করেই ক্ষান্ত হয়নি। ছোট্ট ভাইবোনদের পড়াশোনায়ও সময় দিয়েছে। নিজেও পড়াশোনা করেছে। সব শিক্ষকরা তার প্রতি বিশেষ যতœশীল ছিলেন। তাদের নিকট আমি কৃতজ্ঞ। শরীরের রক্ত বিক্রি করে হলেও আমার ছেলেকে পড়াশোনা করাব। ভবিষ্যতে সে যাতে ভালো কিছু করতে পারে তার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
মুহিবুর রহমান মানিক সোনালী নূর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম জানান, সেবুলকে নিয়ে আমরা গর্বিত। সে খুবই মেধাবী ও ভদ্র। সবসময়ই ক্লাসের পড়াশোনায় মনযোগী ছিল সে। অসুস্থতার কারণে প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিতে পারেনি। যেকারণে তার এক বছর ড্রপ হয়েছে। না হয় সে গত বছরই ভালো ফলাফল অর্জন করতো। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা একদমই শোচনীয়। কোনো সহযোগিতা পেলে হয়তো তার উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম হবে।
অদম্য মেধাবী : দারিদ্র্য দমাতে পারেনি সেবুলকে
Reviewed by প্রান্তিক জনপদ
on
6/05/2020 06:15:00 PM
Rating:
Reviewed by প্রান্তিক জনপদ
on
6/05/2020 06:15:00 PM
Rating:

No comments: